ডেস্ক রিপোর্ট: ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যখন নির্বাসিত জীবন থেকে দেশে ফিরে আসেন তখন তার বয়স ৩৪, দুই শিশুসন্তানের মা ও একজন কর্মপ্রিয় পরমাণু বিজ্ঞানীর স্ত্রী। ’৭৫ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতির পটপরিবর্তনের পরে বঙ্গবন্ধুর দুই প্রবাসী কন্যা ও বড় জামাতা এম এ ওয়াজেদ মিয়া ও শেখ হাসিনার দুই শিশুর সংগ্রামী জীবনের কথা আমরা অনেকেই হয়তো বিস্তারিত জানি না। ১৫ আগস্ট বেলজিয়ামের সকাল থেকে শুরু হয়ে ১৭ মে ’৮১ সালের বৃষ্টিস্নাত ঢাকায় আগমনের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত শেখ হাসিনার জীবন আর ১৭ মে থেকে আজও পর্যন্ত তাঁর জীবন সম্পূর্ণ আলাদা হলেও এই দুই পর্বের জীবনই একটি একক আদর্শ- দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো ও তা বাস্তবায়নের জন্যে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের। সে সংগ্রাম যে শুধু পরিবারের জীবন যাত্রার সংগ্রাম তা নয়। সে সংগ্রাম বাংলাদেশের আর সব সাধারণ মানুষের মতোই, নিজের অধিকার নয় কেবল, দেশের সব মানুষের সম্মিলিত অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। ছাত্রজীবন ও পারিবারিক জীবনের রাজনৈতিক দীক্ষায় প্রশিক্ষিত একজন নারী, একজন বিজ্ঞানীর সম্মানিত স্ত্রী, দুই শিশু সন্তানের যোগ্য মা, তাঁর মতোই একজন পিতৃ-মাতৃহীন অসহায় ছোট বোন, সবাইকে বুকের কাছে আগলে রেখে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে বেঁছে নিতে হলো অভূতপূর্ব এক সংগ্রামের জীবন একটি নবজন্ম দেশের লুণ্ঠিত সম্ভ্রম ফিরিয়ে আনতে। দুনিয়ার নারী নেতৃত্বের ইতিহাসে এমন সাহসের দৃষ্টান্ত বিরল।
টুঙ্গিপাড়ার বাইগার-মধুমতি নদীর কোলে বেড়ে ওঠা শেখ হাসিনার জীবন অন্যরকম হতে পারতো। কিন্তু সময় তাঁকে এনে দিয়েছে এক ভিন্নজগতে। ছাত্র রাজনীতিতে তিনি শিখেছেন নেতৃত্ব আর পিতার কাছে পেয়েছেন আদর্শ। আর এই আদর্শ এমনই এক অবিচল ত্যাগের যার লক্ষ্য তিনি নিজেই বলেন, “…একটাই, সে হলো এই দেশের দুখী মানুষের মুখে হাসি ফুটানো”। পিতার মতোই নিজের জীবনের হাসি-কান্নার কোনো নিকেশ তাঁরা কখনওই করার সুযোগ পাননি, বা সে হিসেব খুঁজেছেন এমন একটি প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি। যদি খুব ক্ষুদ্রমানের একটি উদাহরণ দেই, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কোনো শীতাতপ যন্ত্র ছিল না, এমনকি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও না, আজকের দুনিয়ায় কে তা বিশ্বাস করবে? কিন্তু এই সত্য ধ্রুব সত্য, বাংলাদেশের মানুষের মতোই ছিল আমাদের জাতির পিতার জীবন।
তাঁর জামাতা এম এ ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, “এ দেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুকে একজন দলনেতা হিসেবে যেমন অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করতে দেখেছেন, বঙ্গবন্ধুর পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে দেশের অবিসংবাদিত নেতা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরও তারা তাঁর কোনো পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেননি। বঙ্গবন্ধুর কি বেশভূষা, কি আচার-আচরণ, কি বসবাসের অবস্থা, কি বাড়ির খাবার-দাবার, কেনো কিছুর কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি কোনোদিন। বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির (পুরাতন) ৩২ (নতুন ১১) নম্বর রোডস্থ বাড়িরও হয়নি কেনো পরিবর্তন। তাঁর ওই বাড়ির কোনো কক্ষে ছিল না কোনো কার্পেট, এয়ার কন্ডিশনার বা শীতলীকরণ ব্যবস্থা”। এই যে নির্মোহ, নিরাসক্ত মানুষের জীবন তাঁর আদর্শের প্রভাব সুকন্যা শেখ হাসিনার জীবনের এক অনিবার্য আদর্শ হয়েছে যার অযুত প্রমাণ বাংলাদেশের মানুষ পেয়েছে।
সে রকম আদর্শ চিন্তায় নিমগ্ন শেখ হাসিনা যখন দেশে ফিরেন তখন তাঁকে যেসব প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে দেশটাকে সোজা পথে আনতে চেষ্টা করেছেন তা কি খুব সহজে সাধ্য ছিল? মোটেই না। আমরা জানি না তাঁর সামনের জীবন কেমন হবে কারণ পদে পদে জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু এসে বারবার সামনে দাঁড়ায়। কিন্তু মানুষের যেই ভালোবাসায় তিনি সিক্ত হয়েছেন তাঁর প্রতিদানে বিধাতা এমন একটি প্রাকৃতিক বলয় শক্তি তাঁকে উপহার দিয়েছেন যে কারণে তিনি আজও বেঁচে আছেন ও তাঁর পিতার আদর্শ বাস্তবায়নে নির্বাসন থেকে ফিরে আসার উপযুক্ততা প্রমাণ করেছেন।
আমরা তথ্য অনুসন্ধানে ও ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখতে পাই শেখ হাসিনা “দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার” ওই একটিমাত্র আদর্শই বাস্তবরূপ দিতে অনবরত সংগ্রাম করে চলেছেন। মোটাদাগে দেশের অর্থনৈতিক ভিত মজবুত করে নিতে বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের কলঙ্কমোচন ছিল একটি জরুরি বিষয়, কিন্তু মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী, যারা দেশটা স্বাধীন করতে বাধা দিয়েছিল ও স্বাধীনতার পরও নানা ছল-চাতুরী করে দেশের অর্জন ধুলায় মিশিয়ে দিতে তৎপর ছিল তাদের বিচার করাও ছিল সেই আদর্শের জন্য জরুরি। শেখ হাসিনা ১৭ মে তাঁর দেশে ফিরে আসাকে এইভাবে ইতিহাসের কাছে মূল্যবান করে রেখেছেন, সে মূল্যায়ন মহাকাল নিশ্চয়ই করবে।
কিন্তু আমাদের এখন জানতে হবে এই সংগ্রামী মানুষের ত্যাগের আদর্শের কাছে আমাদের শিক্ষণীয় কি? তাঁর সাথে নানা সময়ে আলাপচারিতায় অন্তত একটি বিষয় আমার কাছে সুস্পষ্ট তিনি একজন আদর্শ মানুষ। যারা কাছে থেকে তাঁকে দেখেছেন নিশ্চয়ই আমার সাথে একমত হবেন। যেসব তথ্য বই-পুস্তক, আলোকচিত্র বা পত্র-পত্রিকায় আমরা পাই তাঁর চেয়ে বড়ো হলো তিনি বাঙালী নারীর চূড়ান্ত সম্মান পেয়েও নিজেকেই অতিক্রম করেছেন তাঁর সংগ্রামী আদর্শের আনুগত্যে। কী নেই তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অর্জনে? সম্মানিত স্ত্রী, গৌরবের মাতৃত্ব, বোনের ছায়াসঙ্গী, আত্মীয় পরিজনের নিকট উপদেশক। কিন্তু সব ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন ‘দুখী মানুষের শেখ হাসিনা’।
আমরা অনেকেই জানি না শেখ হাসিনা সঙ্গোপনে কত মানুষের উপকার করেন। সেই আশির দশকে আমি দেখেছি একজন প্রয়াত সাংসদের ছেলেকে পরম মমতায় নিজের খুঁটের টাকা দিয়ে পাটনায় পাঠিয়েছিলেন ডাক্তারি পড়তে। ২০০৪ সালে তিনি একটি দীর্ঘ তালিকা আমার সাথে শেয়ার করেছিলেন যেখানে গ্রাম বাংলার অসংখ্য শিক্ষার্থীদের নাম ঠিকানা লেখা। তিনি তাঁদের প্রতি মাসে লেখাপড়ার জন্যে টাকা পাঠাতেন। পত্রিকান্তরে অনেক ঘটনাই সুবিদিত যে, শেখ হাসিনা শত্রু-মিত্র ভেদে যে কারও বিপদের দিনে সাহায়তা করতে এগিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেই এই আদর্শের জন্ম। আমরা জানি জেলে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের জন্যে বঙ্গবন্ধু তাঁদের সংসার খরচ চালাতে টাকা পাঠাতেন। এ-ও তো আমাদের মানতে হবে ও শিখতে হবে যে শেখ হাসিনা ফিরে আসার কারণেই এই মানবতার আদর্শ এই মাতৃভূমিতে আরও বিস্তৃততর হতে পেরেছে।
অনেকের কাছে পরিচিত একটি চিঠির সারমর্মে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আদর্শ চিন্তার দর্শন পাওয়া যায়। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার সময়ে তিনি একটি চিঠি লিখেছিলেন সে সময়ে একটি পত্রিকায় কর্মরত কবি নির্মলেন্দু গুণের কাছে। শেখ হাসিনা বন্যার্তদের ত্রাণ দিচ্ছেন এমন ছবি না ছাপাতে অনুরোধ করা এই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, “আমার ধারণা এ ধরনের অর্থাৎ ত্রাণ বিতরণের ছবি টেলিভিশন ও খবরের কাগজে দেখে দেখে মানুষ বীতশ্রুদ্ধ হয়ে গেছে”। আর যাদের ত্রাণ দেয়া হচ্ছে তাঁদের কষ্টের মুখ এঁকে তিনি লিখলেন, “ওরা গরিব, কিন্তু সেটা কি ওদের অপরাধ? এক শ্রেণি যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ না করত তাহলে এরা কি গরিব হতো? কার ধন কাকে বিলাচ্ছে? যা কিছু আছে সকলে মিলে ভাগ করে ভোগ করলে একের কাছে অপরের হাত পাতার প্রয়োজন হতো না”।
এই হলো শেখ হাসিনা! সে আমলেই তিনি এটা মেনে নিতে পারেননি। ১৯৮৮ সালের অক্টোবরে এই ভাবনা একজন কবির কাছে যখন শেয়ার করছিলেন তখন তাঁর বয়স ৪১। দেশে ফিরে মাত্র সাত বছরের নেতৃত্বগুণে সম্পূর্ণ পরিণত এক আদর্শে তিনি সুসংগঠিত হয়ে উঠেছেন। লিখেছেন, “ওদেরই সম্পদ লুট করে সম্পদশালী হয়ে আবার ওদেরই দুর্দশার সুযোগ নিয়ে সাহায্যদানের নামে হাতে তুলে দিয়ে ছবি ছাপিয়ে ব্যক্তিগত ইমেজ অথবা প্রতিষ্ঠা লাভের প্রয়াস আমি মানসিকভাবে কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আমার বিবেকে বাধে”।
সেই অক্ষুণ্ন বিবেক নিয়ে তিনি আজও আমাদের পথিকৃৎ, শুধু আমাদের তাঁকে ভালো করে অনুধাবন করতে হবে। কারণ তিনি মনে করেন, “…যে যাই দান করুক না কেন, বিলি করুক না কেন, এটা তো ওই গরিব মানুষগুলোর অধিকার, তাদেরই প্রাপ্য। ক্ষমতার দাপটে কেড়ে নেয়া ওদেরই সম্পদ অথবা ওদের পেটের ক্ষুধা দেখিয়ে দেশ-বিদেশ থেকে ভিক্ষে এনে এদের দান করা। এখানে ক্রেডিট নেয়ার সুযোগ কোথায়? এই ক্রেডিট নিতে যাওয়াটা কি দুর্বলতা নয়? আত্মপ্রবঞ্চনা নয়? …এই গরিব মানুষগুলোর মুখের গ্রাস কেড়ে খেয়ে আবার এদেরই হাতে ভিক্ষে তুলে দিয়ে ছবি ছাপিয়ে ইমেজ তৈরির পদ্ধতি আমি পছন্দ করি না। আমি মনে করি যা দান করব তা নীরবে করব, গোপনে করব। কারণ এটা লজ্জার ব্যাপার, গর্ব করার ব্যাপার মোটেই নয়। গর্ব করার মতো কাজ হতো যদি এই সমাজটাকে ভেঙে নতুন সমাজ গড়া যেত। গর্ব করার মতো হতো যদি একখানা কাঙালের হাতও সাহায্যের জন্য বাড়িয়ে না দিত। ফুটপাথে কঙ্কালসার দেহ নিয়ে ভিক্ষের হাত না বাড়াত সেটাই গর্ব করার মতো হতো”।
প্রাণস্পর্শী এই চিঠির শেষ তিনি লিখেছেন একটি অমর বাক্য, “যে স্বপ্ন আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেখেছিলেন, সে দিন কবে আসবে”? এই ভাবনা আজ আমাদেরও, সেদিন সত্যিই কবে আসবে! ওই যে দুখি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে জীবনযৌবন বিলিয়ে দেয়া আমাদের বোন, আমাদের মাতৃসম এক চিরন্তন বাঙালি নারীর কাব্য, শুধু তাঁর জন্যে আজ আমাদের প্রার্থনা কী? আমরা জানি তিনি আবার তাঁর প্রিয় জন্মগ্রামে, বাইগার-মধুমতির কোলেই ফিরে যেতে চান, আমরা তাঁর ও তাঁর প্রিয় বাবা যিনি আমাদের জাতির পিতা, তাঁদের আদর্শটুকু আমাদের কাছে রেখে দেই, দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার আদর্শটুকু আমাদের কাছে প্রজন্মান্তরে থাকুক। আমাদের প্রার্থনা হোক, তিনি চিরকালের এই বাংলার।
সূত্র:জাগোনিউজ২৪
লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম
ই-মেইলঃ rezasalimag@gmail.com
Leave a Reply